MASIGNASUKAv102
6510051498749449419

বাঙালিঃ প্রাসঙ্গিক কিছু কথা - Bengali: Some relevant things

বাঙালিঃ প্রাসঙ্গিক কিছু কথা - Bengali: Some relevant things
Add Comments
Monday, April 27, 2020

বাঙালিঃ প্রাসঙ্গিক কিছু কথা - Bengali: Some relevant things

মাসুদ আলম
......................



দাখিল নবম-দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্য বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "দূরন্ত আশা" নামক একটি কবিতা ছিলো। সেই পড়াকালীন সময়ে তোতাপাখির মত মুখস্থ করে পড়েছিলাম শুধু, মর্মার্থ বুঝিনি। এখন বুঝি কবিতাটিতে রবি ঠাকুর বাঙালি জাতির আপাদমস্তক চরিত্র চিত্রন করেছেন। কবিতার প্রত্যেকটি লাইনে বাঙালির যাপিত জীবনের বাস্তবতা ও নানা মানসিক জটিলতার কথা বলে গেছেন কবি। আসুন, কবিতার বিশেষ বিশেষ পঙক্তিগুলো পর্যালোচনা করে দেখি।

প্রথম দুই পঙক্তিঃ
"মর্মে যবে মত্ত আশা সর্প সম ফোঁসে,
অদৃষ্টের বন্ধনেতে দাপিয়া বৃথা রোষে। "

আমাদের, অর্থাৎ বাঙালিদের আশার কোনো আদিঅন্ত নেই। আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, ভালোবাসি স্বপ্নের কথা জনমনে প্রচার করতে। আমাদের আশাগুলো কখনো এতটাই বৃহদাকার এবং দূরন্ত হয় যে, আশা আকাঙ্খা হৃদয় কোণে গোখরা সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে থাকে।

কিন্তু আমাদের আশা, আশা পর্যন্তই। স্বপ্নগুলো দেখা পর্যন্তই। কর্ম করে ফলে রূপায়ণে আমরা বরাবরই ব্যর্থ। কারণ আমরা অকর্মণ্য। তাই যখন আমাদের আশাগুলো, স্বপ্নগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন আমরা অদৃষ্টের, তথা ভাগ্যকে দোষারোপ করে বৃথাই দাপিয়ে মরি। আমরা এমনই।

পরবর্তী পঙক্তিঃ
"তখনো ভালো মানুষ সেজে
বাঁধানো হুঁকা যতনে মেজে
মলিন তাস সজোরে ভেজে
খেলিতে হবে কোষে। "!

বাঙালি, তথা আমার কখনো আত্ম বিশ্লেষন করি না। আমরা আপন যুক্তিতে অনড়ভাবে কয়েম থাকতে পারি ভুল জেনেও। ভুলের উপর আছি তো কী হয়েছে? সেই ভুলকেই ভিত্তি করে আমরা নবতর ভুলেভরা ইমারত গড়ে তোলায় প্রয়াসী হই। চর্যপদের ভাষায়, "আপনা মাংসে হরিণা বৈরী" র মত, আমাদের কৃত ভুলের জন্য আমরা ধ্বংস হয়ে যাব... তবুও "মলিন তাস সজোরে ভেজে আমাদের কোষেই খেলতে হবে"। কারণ, আমরা বাঙালি। অপরাজেয়, অদম্য আমাদের স্বপ্ন, আমাদের আশা আকাঙ্খা!

এর পরের পঙক্তিতে কবি আমাদের চরিত্রের একটি মৌলিক দিক তুলে ধরেছেন। এই দিকটির কথা এখন বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, "চায়ের আড্ডাগুলো ভেঙ্গে না দিলে এতদিন করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়ে যেত!"

"অন্যপায়ী বঙ্গবাসী
স্তন্যপায়ী জীব,
জনদশেকে জটলা করি
তক্তপোশে বসে। "

আমরা অন্যের উপর নির্ভরশীল। একসময় আমরা হয়তো ভারতীয় উপমহাদেশের মালিক ছিলাম। ভোগবিলাসীতা, লোভ আর অকর্মন্যতার দোষে শাসনদণ্ড চলে যায় বিদেশি তথা ইংরেজদের হাতে। তারা আমাদের মধ্যে নানা ধরণের শ্রেণি বিভেদ, বাজে অভ্যেস, হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দিয়ে পঙ্গু করে দিয়েছে। আমাদের চিন্তাশক্তিকে করে দিয়েছে ভোঁতা। 

স্তন্যপায়ী জীব, যেমন গরু ছাগলের কোনো বোধবুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, আত্মোন্নতির চিন্তা নেই... তেমনই, অসচেতনতার দৌড়ে আমরা বাঙালি মনুষ্যকুল পিছিয়ে কই?

আর জনাদশেকের জটলা তো আমাদের বাঙালিদের যাপিত জীবনের ঐতিহ্য। যারা জটলায়, আড্ডায় সময় ব্যায় করে না...তাদের বাঙালিত্বের গোড়ায় গলদ আছে বৈ কি? এই যে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব, আড্ডা কী কমেছে? বাঙালি জীবন দিতে রাজি, চায়ের আড্ডা ছাড়তে রাজি নয়। তাই তো অনেক জ্ঞানী(!)রা বলছেন, "পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা হবে, পৃথিবীতে বাঙালি নামক এক জাতি ছিলো, তারা চায়ের আড্ডায় গিয়ে নিজেদের ধ্বংস করে দিয়েছে!" মরি মরি কী গর্বের কথা!

আমার বন্ধু জাবের, এই গর্বের মূলে সুরসুরী দিয়ে তাই বলেছে, "লক ডাউন তুলে নেয়া হোক। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসুক। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীদের ছুটিতে পাঠানো হোক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জরুরী সেবায় যারা এতদিন নিয়োজিত ছিলেন, তাদেরকে ছুটি দিয়ে দেয়া হোক। সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাক।
যারা বাঁচে বাঁচুক, যাদের হায়াত নেই, তারা মরে যাক!

মরার আগে অন্তত মনমতো ঘুরেফিরে মরুক। পছন্দের প্রিয় খাবার খেয়ে মরুক। আত্মীয় স্বজন, প্রিয় মানুষের সাথে শেষবারের মত গলাগলি, কোলাকুলির সুযোগ পেয়ে মরুক। খায়েশ মিটিয়ে মারামারি করে মরুক। প্রাণ ভরে মিছিল মিটিং, ওয়াজ মাহফিল করে মরুক। দল বেধে মরুক!
মৃত্যু হোক আনন্দময়!"

কথা সত্য। এছাড়া বাঙালির জীবনে আছে কী?
তারপর কবিগুরু বাঙালি হওয়ার আনন্দের একঘেয়েমিতে, নাকি দুঃখে দুঃখিত হয়ে বললেন...
"ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন। "।

আরব বেদুইনদের সংগ্রামী জীবনে প্রতি কবি হয়তো মুগ্ধ হয়েছিলেন। কারণ, মরুর দিগন্ত পেরিয়েই তো মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারত জয় করেছিলেন। মরুর দিগন্ত পেরিয়েই সারা পৃথিবীতে মুসলিমরা ইসলামের ঝান্ডা গেড়েছিলেন। আরবিদের যাপিত জীবনের সাথে বাঙালির জীবন যাত্রার যে বিস্তর ফারাক তাতো সকলেরই জানা। কবি নিপুণ হতে সেটি তুলে ধরেছেন।

এ তো দূরন্ত আশা কবিতার কথা। কবিগুরু কিন্তু এর চেয়ে মারাত্মক একটি উক্তি রেখে গেছেন আমাদের জন্য।
"সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।"

এটা কিন্তু বাঙালির শানে চরম অপমানজনক কথা! মাঝে মাঝে আমরা এই কথাটি মেনে নেই। আবার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি সামনে আসে, তখন ঘোর বিরোধী হয়ে যাই। মনে মনে বলি ঠাকুর আমাদের কুষ্টিয়া আর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের জমিদারির টাকায় খেয়ে পরে আমাদের নিয়েই এতো বড় কথা বলেছে! আবার শ্বশুর বাড়িটাও আমাদেরই যশোরে। ইচ্ছে হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে টেঁটাসহ আগ্রাসী যুবকদের হায়ার করে নিয়ে নিমতলায় যাই। গিয়ে ছাই ভষ্ম কিছু খুঁজে বের করে একদফা কেলিয়ে আসি।

একটু হিসেব করে দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ। স্যার সলিমুল্লাহ যদি চেষ্টা তদবির আর নিজের জমি না দিতেন, তাহলে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই হতো না। স্যার সলিমুল্লাহর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগুরুর জন্মদিনকে জন্মজয়ন্তী আর মৃত্যুদিনকে মহাপ্রয়াণ আখ্যা দিয়ে মহাসমারোহে স্মরণ করা হয়। কিন্তু স্যার সলিমুল্লাহর জন্মদিন আর মৃত্যুবার্ষিকী কোনদিক দিয়ে আসে যায়, তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না! এখানে কি কবিগুরুর এই উক্তি আমাদের গালে জুতার বাড়ি মারে না?

আসলে আমাদের চরিত্রই এমন। আমরা সামনে দিয়ে পিপড়া গলতে দেব না, পেছন দিয়ে হাতি বাঁশ দিয়ে যাক...আফসোস নেই। কবিগুরু বেশ ভালো করেই আমাদের স্বভাব চরিত্র আয়ত্ত করেছিলেন। তাই তিনি কবিতায় আমাদের এসব দিক তুলে ধরেছেন, এ থেকে যেন আমরা শিক্ষা নিতে পারি।

কবিগুরুর এই উক্তিকে ভিত্তিহীন করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর দেশে এসে জাতির উদ্দেশ্য যে ভাষন দিয়েছিলেন, সেই ভাষনে তিনি বলেছিলেন, "কবিগুরু তুমি বলেছিলে, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। আজ তুমি এসে দেখে যাও, আমার বাঙালিরা মানুষ হয়েছে, তারা তাদের দেশকে স্বাধীন করেছে"। তার কিছুদিন পরেই "ত্রাণের কম্বল" ইস্যুতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "সবাই পেয়েছে সোনার দেশ, আর আমি পেয়েছি চোরার দেশ"। বঙ্গবন্ধু যে মানুষদের নিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই মানুষেরাই কম্বল চুরি করছে। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। সেই চোরের বংশধরেরাই এখন "ত্রাণের চাউল" চুরি করে। তারা বিছানার নিচে চুরি করা তেল রেখে উপরে শুয়ে ঘুমায়। হ্যাঁ, আমরা সেই বাঙালি!

শেষ করছি কবিগুরুর কয়েকটি পঙক্তি দিয়েই,
"পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।"